সাম্প্রতিক সরকারি জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে প্রায় ৯.২ শতাংশ শিশুশ্রমের সঙ্গে জড়িত, যা দেশের জন্য এক গভীর উদ্বেগের কারণ। এই পরিসংখ্যান দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও সামাজিক সুরক্ষাব্যবস্থার দুর্বলতা এবং দারিদ্র্যের গভীরতাকে স্পষ্ট করে তোলে। বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় শিশুদের অংশগ্রহণ তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে মারাত্মক বাধা সৃষ্টি করছে, যা তাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। দ্য ডেইলি স্টার-এর এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই প্রবণতা দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করছে এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে।
শিশুশ্রমের পাশাপাশি বাল্যবিবাহও বাংলাদেশের শিশুদের জীবনকে এক অন্ধকার ছায়ায় ঢেকে রেখেছে। যদিও প্রাথমিক বিদ্যালয় শেষ করা শিশুর হার প্রায় ৮৪ শতাংশ, মাধ্যমিক স্তর শেষ করার ক্ষেত্রে এই হার অর্ধেকেরও কম। বাল্যবিবাহের কারণে অসংখ্য মেয়ে শিশু তাদের পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারে না, যার ফলে তারা বাল্যকালেই মা হয়ে যায় এবং স্বাস্থ্যগত ঝুঁকিসহ নানা সামাজিক সমস্যায় জর্জরিত হয়। প্রথম আলোর সাম্প্রতিক বিশ্লেষণ অনুযায়ী, এই শিক্ষাবিমুখতা এবং বাল্যবিবাহের চক্র শিশুদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে এবং তাদের একটি সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবন থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে।
শিশুশ্রম, বাল্যবিবাহ এবং শিক্ষাবিমুখতার পেছনে রয়েছে গভীর আর্থ-সামাজিক কারণসমূহ। দারিদ্র্য, পরিবারের আর্থিক সংকট, পিতামাতার সচেতনতার অভাব এবং শিক্ষার সুযোগের অপ্রাপ্যতা এই সমস্যাগুলোকে আরও জটিল করে তুলছে। অনেক পরিবারে শিশুদের আয় তাদের টিকে থাকার জন্য অপরিহার্য হয়ে দাঁড়ায়, যার ফলে তারা পড়াশোনা ছেড়ে উপার্জনের পথে পা বাড়ায়। যুগান্তর-এর এক বিশ্লেষণে দেখা যায়, দেশের কিছু অঞ্চলে প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে আমন ধানের ফলন কমে যাওয়ায় এবং সামগ্রিক মূল্যস্ফীতির ঝুঁকির কারণে দরিদ্র পরিবারগুলো আরও বেশি চাপে পড়ছে, যা শিশুদের শ্রমবাজারে ঠেলে দেওয়ার অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
শিশুশ্রম, বাল্যবিবাহ ও শিক্ষাবিমুখতা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এক বিশাল চ্যালেঞ্জ। এই সমস্যাগুলো কেবল শিশুদের ব্যক্তিগত জীবনকেই প্রভাবিত করে না, বরং দেশের সামগ্রিক মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতেও দীর্ঘমেয়াদী নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এই সংকট মোকাবিলায় সরকার, বেসরকারি সংস্থা এবং সমাজের সকল স্তরের মানুষকে একযোগে কাজ করতে হবে। শিশুদের জন্য মানসম্মত ও সহজলভ্য শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করা, দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচি জোরদার করা, বাল্যবিবাহ রোধে কঠোর আইন প্রয়োগ এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা অপরিহার্য। একটি সুস্থ ও শিক্ষিত জাতি গঠনে শিশুদের সুরক্ষা ও অধিকার নিশ্চিত করা সর্বাগ্রে প্রয়োজন।